১.
তালাক !
তালাক !!
তালাক !!!
আয়না ডুকরে ওঠে হাত জোড় করে বলে, আল্লাহর দোহাই লাগে এমন কাজটা আপনে কইরেন না !
জলিল হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, খানকি ! তুই অহনই বাইর হ আমার বাড়িত্থন !
আমার পেটে তো আপনের বাচ্চা ! বাচ্চাডার কী হইবো ?
আগেতো কস নাই তোর পেটে আমার বাচ্চা। অহন কস ক্যান ? নষ্টা মাইয়্যা মানুষ ! কার না কার বাচ্চা আমারে বাপ ডাকবো ক্যান ? আমি য্যান তোর মুখ আর না দেখি।
আয়না সুসংবাদটা দেবার আগেই তার জীবনে নেমে এলো ঘোর অমানিশা।
ভেবেছিলো যখন বাচ্চাটা পেটে নড়াচড়া শুরু করবে তখন জানাবে স্বামীকে। স্বামী পেটে হাত দিয়ে বাচ্চার নড়াচড়ায় শিহরিত হবে।
১৯৭১ সাল এপ্রিলের শুরুর ঘটনা সেটা।ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ ডাকবাংলো তখন রেলের যে মোটা রেললাইন সেই ছাতিশের উপর ঢালাই করা পুরনো একটি দোতলা বাড়ি। এটিকে এলাকার মানুষ কালীবাড়ি হিসেবেও চিনে। পেছনে ২০ গজ দূরেই এর প্রাচীরের শেষ যেখানে অতি বর্ষায় সেখানে ব্রহ্মপুত্রের ঢেউয়ের পানি এসে সেখানে আছড়ে পড়ে। এই পানি একেবারে প্রাচীরের কাছে থাকার কারণে আলবদর বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ করে যাদেরকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করেছে তাদেরকে এই নদীতে ফেলে দিয়েছে। রক্তাক্ত লাশ ভেসে গেছে। এরা প্রথমদিকে রাস্তাঘাটে যাকে পেত স্টেশনে, বাস স্টেশনে, রেল স্টেশনে, কাচারী গুদারা ঘাট, কালি বাড়ি গুদারাঘাটে যে সমস্ত মানুষ ময়মনসিংহ শহরে এসেছে জীবন বাঁচাতে ওষুধের জন্য, হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এমন গ্রামের মানুষদেরকেও তারা সন্দেহ করে তরুণদের ধরে নিয়ে এসে এখানে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।
এমনই কোন এক সন্ধ্যায় জলিল নিখোঁজ হলো। মূলত তাকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী প্রধান কামারুজ্জামান খান।কিন্তু কে ধরে নিয়ে গেছে জলিলকে সে খবর পেতে পেতে দু’দিন পার হয়ে গেছে।
প্রাণ প্রতিম স্বামীকে যখন আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে তখন আয়না নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে স্বামীর খোঁজে ডাকবাংলো যায়।সেখানে তখন বন্দুক নিয়ে অনেক লোক ঘোরাঘুরি করছিল। তাদেরকে আয়না জলিলের আটকে রাখার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা তাঁর আটকের কথা অস্বীকার করে। আয়না সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা সবসময়ই ডাকবাংলোর গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করে বলতো, ”যে লোক আমাকে খাওয়া পরা দেয় তাঁরে যহন তুমরা আটকাইয়া রাখছো, তহন আমারে আর আমার পেডের বাচ্চাডারে তুমরা মাইরা ফালাও।” কিন্তু কে শোনে কার কথা। আয়নার কথা কারো কানেই যেতো না।
আয়না তখন চকবাজারের মহাজন শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ইমাম আব্দুর রহমানের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে বলে, হুজুর, আপনে সুপারিশ কইরা আমার স্বামীরে ছাড়াইয়া আইনা দ্যান।ইমাম আব্দুর রহমান কী করবেন আয়না না জানলেও ভরসা পেয়েছিলো স্বামীকে ফিরে পাওয়ার।
আয়না উদভ্রান্তের মতো স্বামীর মুক্তির জন্য নানা জায়গায় ছুটোছুটি ও কান্নাকাটি করে বেড়াচ্ছে যখন তখন রফিকুল নামে এক আলবদর তার মায়ের মাধ্যমে জানায়, সত্যি সত্যি জলিল ডাকবাংলোতে আটকে আছে। কিন্তু রফিকুল আয়নাকে সতর্ক করে দেয় যে, এই খবর যে রফিকুলের মাধ্যমে সে জেনেছে তা যেনো আয়না আর কাউকে না জানিয়ে অন্য একটা কিছু বলে দেয়।
অবশেষে আয়নার এক দুলাভাইয়ের মাধ্যমে ৮ দিন বন্দি থাকার পর জলিলকে ফিরে পায় আয়না।কিন্তু জলিলের কাছ থেকে এলাকাবাসী জানে যে তার শরীর থেকে আধালিটার রক্তও নাকি নিয়েছে আলবদর বাহিনী।
সেদিন সন্ধ্যায় জলিল গিয়েছিলো মসজিদে মাগরিবের পর শোকরানা মিলাদ দিতে।বাসায় রফিকুল এসেছিলো আয়নার সাথে দেখা করতে। এমন নারী যেই পুরুষের ঘরে আছে সেই পুরুষের জীবন ধন্য বলে রফিকুল নিজের বোন বলে আয়নার হাত ধরে বলে, বইন আমারে দোয়া কইরা দেও য্যান তোমার মতন একটা মাইয়া আমার ঘরে বউ হইয়া আসে।
মসজিদ থেকে ফেরার পথে কানাঘুষায় শুনছিলো আলবদর বাহিনীর সাথে আয়নার বিশেষ সম্পর্কের কথা। শুনে জলিলের মন ঘেন্নায় বিষিয়ে ওঠে। মন মানতে চায় না আয়নার অধপতনের কথা। কিন্তু কপাল যখন পোড়ে তখন এভাবেই পোড়ে হয়তো।বাড়ি ফেরার পথে জলিল জানালার আলো দিয়ে দূর থেকে রফিকুলকে দেখতে পায় আয়নার হাত ধরে আছে।যখন বাড়ির কাছে চলে এসেছে ততক্ষণে রফিকুল চলে গেছে।জলিল মানুষের কান কথা মানতে চাইছিলো না। কিন্তু যখন দূর থেকে রফিকুলের হাত ধরা অবস্থায় দেখলো ততক্ষণে জলিলের মাথায় রক্ত ওঠে গেছে।
২.
মঈন আর রুনুর মধ্যে প্রায়শই চলে অনেক তিক্ত কথার বাক বিতণ্ডা। ওদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়েছে মূলত তৃতীয় পক্ষের প্রবেশের কারণে। সাবর্ডিনেট সামিরার সাথে মঈনের সম্পর্কটা হাতেনাতে ধরার পর থেকে রুনুর সাথে মঈনের সম্পর্কটা চরম খারাপ আকার ধারণ করেছে। এবার রুনু আর মেনে নিতে পারছে না। যে মানুষটিকে এতোদিন দেবতার আসনে বসিয়েছে তাকে নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে দেখতে রুনুর খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে। নারী স্বামীর দেওয়া সব কষ্ট সহ্য করতে পারলেও স্বামীর অধিকারে কাওকে ভাগ দিতে সে রাজি নয়। রুনুও ভাগ দিতে রাজি হয়নি। ছেড়ে যাবে প্রয়োজনে তবুও ভাগ দিবে না।
এভাবে চলতে চলতে সম্পর্কের সুতোটা অবশেষে ছিঁড়েই গেলো।
জলিল খুব চেষ্টা করেছিলো কিন্তু মেয়ের জেদের কারণে সম্পর্কটাকে জোড়া লাগাতে পারেননি। মেয়েটাও একেবারে বাপের মতো। চেহারাও যেমন বাপের মতো, স্বভাবেও বাপের মতো গোয়াড় হয়েছে।
রুনু যেদিন হলো দাই মা অবাক হয়ে বললেন আরে এইডা যে আমগো জলিলের মায়ের লাহান দেহি ! এক্কেবারে জামিলা বুর মুখটা য্যান বাচ্চাডার মুখের মধ্যে বসাই দিছে। জলিলের কানে গিয়েছিলো কথাটা। একটু অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করছিলো। বাচ্চাটা নাকি তার মায়ের মতো হয়েছে।জামিলা খুব সখ করে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আয়নাকে বাড়িতে তুলেছে কেবল। বছর না ঘুরতেই আয়নার হাতে সংসার তুলে দিয়ে জামিলা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। আয়নাকে বড় স্নেহ করতেন জামিলা। সম্পর্কটা কেবল বউ শাশুড়ি ছিলো না। বরং মা মেয়ের চেয়েও বেশি কিছু। হয়তো বন্ধুত্ব বলে একে। জলিল মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে মায়ের বিরুদ্ধে মায়ের কাছেই নালিশ জানাতো।
বিয়া করাইলা আমারে আর বউ দেহি তুমার পিছ ছাড়ে না, মা ! এতো খাতিরতো বউ শাশুড়ির মধ্যে দেহা যায় না। কাহিনিডা কী কও দেহি ? কপট রাগ দেখায় জলিল।
জামিলা হেসে বলে, বুড়ি ছুড়িতে সখি হইছি। তোর এতো জ্বলে ক্যা ছ্যাড়া ?
রাতের বেলা আয়না জলিলের কাছে এলে জলিল মেকি অভিমানে গাল ফুলাতো, যাও তুমার সখির কাছে। আমি কেডা ?
আয়নাও হেসে উল্টো পথে রওনা দিতো, তাইলে গেলাম কিন্তু। অমনি হ্যাচকা টানে আয়নাকে কোলের উপর নিয়ে আসতো। জলিলের মুখে তৃপ্তির হাসি। বউ শাশুড়ির এমন সুন্দর সম্পর্ক দেখা যায় না। কিন্তু জলিলের দাদীও খুব আদর করতেন জামিলাকে। ছোটবেলায় জলিল খুব দেখেছে সেটা।
জলিলের নানা নানীও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আসলে পারিবারিক সুসম্পর্কগুলো হয়তো বংশ পরম্পরায় চলে। এর মধ্যে কেউ একজন দোষের হলেই সুসম্পর্কের সুরটা কেটে যায়। তারপর থেকেই বেসুরো হয়ে যায় জীবনের গান।জলিল নিজের চোখে তার তিন পুরুষের মহানুভবতা দেখেছে। দেখেছে ঘরের নারীকে কীভাবে সম্মান করে মাথায় তুলে রাখতে হয়। এ সম্মানে নিজের কোন ক্ষতি নেই। বরং সংসার নামক বাগানটা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে।
৩.
আয়নার তিনকুলে যাওয়ার কোন জায়গা ছিলো না। সারারাত রান্নাঘরে কাটিয়েও কোন কুল কিনারা করতে পারলো না কী করবে সে। জলিল এখন আর ধর্মমতে তার স্বামী না হলেও আয়না জানে বাচ্চাটা জলিলের।রাগের বশে ভুল বুঝে স্বামী তার তালাক দিলেও বড় বেশি ভালোবাসতো আয়নাকে। যা ঘটে গেছে তার জন্য আয়নাও প্রস্তুত ছিলো না। রফিকুল এভাবে হঠাৎ করে বাড়ি চলে আসবে ভাবতে পারেনি আয়না।কোন কিছু প্রমাণ করার সুযোগ রইলো না।জলিল বা সে যে আবার রফিকুলের খোঁজ করবে সে উপায়ও নেই। আলবদর বাহিনীর খোঁজ করা মানে যেচে পড়ে নিজের জীবনকে মৃত্যুর কাছে সপে দেওয়া।
প্রতিবেশি দাইমার একলা ঘরে শেষে আয়নার আশ্রয় হলো। আর দাইমা গিয়ে জলিলের বাড়িতে রেঁধে বেড়ে আসে। এভাবেই একসময় আয়নার কোলে রুনু আসে।
এবার যেন ভুল ভাঙে জলিলের। তালাক দেওয়া নারীকে আবার বিয়ে করার বিধান নেই ধর্মে। এক চালের নিচে রাখলে সমাজও মানবে না।জলিল মানতে পারে না আর কোন পুরুষের হবে আয়না।আয়নাও মেনে নেয়নি দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব।
জীবন বড় অদ্ভুত। সাধারণত তালাকের পর নারী আর কোন পুরুষকে কয়েকদিনের জন্য বিয়ে করে ইদ্দত পালন করে পূর্বের স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু নিজেদের ভেতর অপর পুরুষকে প্রবেশ করতে না দিয়ে একই চালের নিচে দু’টি নরনারী নিজভূমে পরবাসী হয়ে বছরের পর বছর পার করে দিলো।
সে রাতে রফিকুল আয়নার কাছে না এলে জলিলের কানে প্রতিবেশীদের ঢালা বিষ উগড়ে বেড়িয়ে আসতো না।আর আয়নার জীবনটাও বোতলবন্দি হয়ে যেতো না। মৃত্যুই যেনো কেবল এর একমাত্র মুক্তির উপায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এক নারীর জীবনের গল্প শুরু হতে পারতো নতুন করে। কিন্তু তা একরাতে নিকষ আঁধারে ভরে যায়।
২৮ মার্চ - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
২২ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৭৩
বিচারক স্কোরঃ ২.৩৩ / ৭.০পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।